কর্ণপাত

কর্ণপাত 





কর্ণের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয় কলেজের শেষ দিনে। 

সত্যি বলতে কি , ছেলেটাকে সেরকম  নোটিশ করিনি কোনোদিন। চুপচাপ টাইপের ছেলে , ক্লাসে বেশি কথা বলতো না , তার ওপর পড়াশোনায় ভালো।  আমরা জেনারেল পাবলিকরা একরকম এড়িয়েই চলতাম।  ওই মাঝে মধ্যে হোমওয়ার্ক টোকার জন্য হেল্প করতো এই যা।  কিন্তু শেষের দিন  যেন কেমন  ইমোশনাল হয়ে গেলাম।  ভাবলাম , ভ্যাবলাটার সঙ্গে আর তো কোনোদিন দেখা হবে না , যাই, একটু বাই বলে আসি। 

তা তখন সবাই জামায় সই করতে ব্যস্ত, আমিও এই অছিলায় ওর জামা ধরে দিলাম এক টান। 

ছেলেটা আঁতকে  উঠলো ! 

আমিও একটু থতমতো খেয়ে গেছিলাম।  পরে সামলে নিয়ে বললাম , "আরে ঘুরে দাঁড়া , একটা গুডবাই মেসেজ তো লিখে দি !"

কর্ণ কিছুক্ষণ হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে রইলো , তারপর আস্তে করে ঘুরে দাঁড়ালো।  আমি একটা গতানুগতিক শুভেচ্ছা লিখে বললাম ," নে এবার তুই লেখ। "

আমার হাত থেকে মার্কারটা নিয়ে লিখলো। বেশ টের  পেলাম ওর হাত কাঁপছে।  যাই হোক, কি যেন লিখে মার্কারটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে একরকম দৌড়ে পালালো।  

আমিও অন্যদের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে শার্টটা রাখতে গিয়ে দেখি কর্ণ জামাটাতে নিজের নামের সাথে ফোন নম্বর দিয়েছে! 

বেশ লাগলো। নাম্বারটা সেভ করে রাখলাম। 

তারপর একদিন ও নিজেই ফোন করে কথা বললো।  যেখানে ভেবেছিলাম আর কোনোদিন দেখা হবে না এখন দেখলাম মাঝে মাঝেই কথা ও দেখা সবই হতে লাগলো।

 তারপর গতানুগতিক যা হয় বাঙালি ঘরে। কখনো মলে, কখনো লেকে বা কখনো ভিক্টোরিয়ায় আমাদের দেখা যেতে লাগলো। সেভাবেই হয়তো বাড়িতেও খবর গেলো। তা, বিশেষ হৈচৈ হয়েনি। বিয়েটাও নির্বিঘ্নে হয়ে গেলো।

আসল ঝামেলা শুরু হলো ফুলশয্যার রাত থেকে। 

*

"এই শ্রীপর্ণা ! তোর কি হয়েছে বলতো ?"

আমি ক্লান্ত চোখে সিসিডির  জানলা দিয়ে গোলপার্কের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।  বোধহয় নয়নার ডাকে আমার সংবিৎ ফিরলো।

"ইয়ে হ্যাঁ বল বল। " আমি অন্যমনস্ক ভাবে বললাম।  ও তাতে আমাকে আরো জোরে  ধরলো। 

"কি রে কি হয়েছে ? পাঁচ দিনের টাটকা কনে এরকম মুখ ঝুলিয়ে বসে কেন? কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি রে ? সব ঠিকঠাক তো ?"

ওর ইঙ্গিতপূর্ণ চোখপাকানো দেখে আমি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম। 

"ধ্যাৎ ! ওসব কিছু না।  সমস্যা আরো গুরুতর।  আমার সব শুনেটুনে বিয়ে করা উচিত ছিল ভাই !"

"কেন রে ? শুনে টুনে মানে কি ?" দেখলাম নয়নার মুখচোখ শক্ত হয়ে গেছে।  "কর্ণের কি আগে অন্য কারোর সঙ্গে -"

"না রে না ," আমি ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলি।  "ও খুব নাক ডাকে রে !"

নয়না কিছুক্ষন চুপ করে রইল। তারপর প্রায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আমি একটু রেগেই বললাম, 

"নিজের হলে আর মজা করতিস না।   জানিস,আমি এতোদিন ঠিক করে ঘুমোতে পারিনি ? কি ভীষণ নাক ডাকে ! মনে হয় পাশে মালগাড়ি যাচ্ছে।  আর পারছি না! সোজাসুজি বলেও কোনো লাভ হলো না !"

"কি বলছে ?" নয়না জিজ্ঞেস করলো।

" বলছে, আমি তো নাক ডাকি না ! একেবারে অবাক হয়ে গেলো জানিস! যেন আমি ভয়াবহ কিছু বলছি এমন ভাবে তাকালো আমার দিকে।"

"সব নাক ডাকিয়েদের এক ঝামেলা।  কেউ মানবে না যে নাক ডাকে।"

"তোর বাড়িতে -"

"মা।  বাবার এই তোর মতো অবস্থা হয়েছিল।

"তা হলে উপায় ?"

"কানে তুলো গোঁজ। এছাড়া আর তো কোনো উপায় দেখছি না। " নয়না কিছুটা নিরুপায় হয়ে বললো।

কিছুক্ষন  চুপ করে রইলাম আমরা দুজনেই। ক্যাফের ঠাণ্ডা পরিবেশেও আমার মাথা আস্তে আস্তে গরম হয়ে উঠছিলো। এভাবে ফট করে বিয়ে করাটা এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়েছে।  আমি কি করবো ভেবে পেলাম না।

"কি এতো ভাবছিস ? নাক ডাকে তো কি ? নাক তো কত লোকই ডাকে রে বাবা।  তা বলে কি ডিভোর্স করবি নাকি ?"

"হুম। দেখা যাক।  করতেও পারি। এভাবে চললে আমি মরে যাবো।"

কিন্তু আমি মরলাম না।  উল্টে সে জন্ম নিলো।

*
বুঝতেই পারছেন কার কথা বলছি। সাধারণত বিয়ের বছর খানেক বাদে যার আগমন হয় সেই শয়তা- মানে সন্তানের কথা বলছি। একটা ফুটফুটে ছেলে।  তাকে দেখে সকলে সব ভুলে গেলেও আমি ভুলি নি।  এবং আমি তাকে বাড়িতে নিয়ে আসার কয়েক দিন বাদেই বুজলাম যে এবার আমি কর্ণর বিরূদ্ধে একখানা মোক্ষম অস্ত্র পেয়েছি।

যেদিন ডিট্টো  (আমার বাচ্চার ডাকনাম; কেন ডিট্টো তা ক্রমশ প্রকাশ্য ) কে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম সেদিন চারিদিকে বেশ খুশি খুশি আবহাওয়া।  সকলে ডিট্টো কে নিয়ে ব্যস্ত।  আমি কিন্তু অপেক্ষা করতে লাগলাম যে কখন আসবে আজকের রাত। 

সেদিন রাতে যখন কর্ণ ডিট্টো কে নিয়ে উলো মুলো যাবি জাবি বকছে , আমি কানে অল্প করে তুলো (নয়নার কথা মনে করে) গুঁজে নিলাম। তারপর বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। 

মাঝরাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। 

দেকি কর্ণ  ভয়ে ভয়ে আমাকে ডাকছে। 

"কি হয়েছে?" আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

"আম...মানে ডিট্টোর কি কিছু হয়েছে ? কেমন একটা শব্দ করছে?"

আমি মনে মনে অট্টহাসি হাসছি তখন।  এই তো চাই ! দেখ কেমন লাগে! আমি তুলোটা আরো ভালো করে গুঁজে একটু উঠে ডিট্টোকে দেখে নিলাম।

পারফেক্ট !

"আরে ও কিছু না।  নাক ডাকছে। "

কর্ণ কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো।  তারপর কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে গেলো।  

"এই অনেক রাত হয়েছে।  এবার শুতে দাও। " আমি আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।

কর্ণ দেখলাম নাক ডাকার শব্দে ঘুমোতে পারছে না।  আবার কিছু বলতেও পারছে না।  কাকে বলবে সে তো কিছুই বোঝে না !

বাপকা ব্যাটা একেবারে।

*********************************

      লেখক : নিমো               
 ছবি : Pixabay
                         

Comments

Popular Posts